শিক্ষা কী? একটি গভীর বিশ্লেষণ: প্রাচীন থেকে আধুনিক ধারণা (What is Education? A Deep Dive: From Ancient to Modern Concepts)

ভূমিকা (Introduction):

“শিক্ষা” শব্দটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা সবাই এই শব্দটির সাথে কমবেশি পরিচিত। দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের মতে, মানুষের অন্তর্নিহিত সামাজিক বা সাংস্কৃতিক চাহিদা পূরণের মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ এক পরিপূর্ণ জীবনের অধিকারী হতে পারে। অনেকে শিক্ষাকে জীবন ধারণের একমাত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করেন। তাই মানুষের জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রভাবকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শিক্ষা কী?

‘শিক্ষা‘ শব্দের কোনো একক বা সর্বজনীন অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে শিক্ষাবিদ ও চিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্যের দরুন দুটি মূল ধারণা পাওয়া যায়:

প্রথমত: ‘শিক্ষা‘ শব্দটি সাধারণ কথোপকথনে বহুল ব্যবহৃত হলেও, এটি একটি বিমূর্ত অর্থবহ ধারণা, যা গভীর বিশ্লেষণ ও আলোচনার দাবি রাখে।

দ্বিতীয়ত: ‘শিক্ষা‘ সম্পর্কিত ধারণাটি গতিশীল (Dynamic)। এটি পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত বিকশিত হয়।

এই দুটি ইঙ্গিত থেকে আমরা বলতে পারি – ‘শিক্ষা হলো বিমূর্ত অর্থবহ ধারণার সমষ্টি, যা গতিশীল, পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে বিকাশশীল।‘

‘শিক্ষা কী‘ তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে বিভিন্ন দেশ ও সমাজব্যবস্থায় এই সম্পর্কিত যে ধারণাগুলো প্রচলিত আছে, তা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।

প্রাচীন ভারতীয় ধারণায় শিক্ষা (Educational Concept of Ancient India)

প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক ও চিন্তাবিদগণ নানাভাবে শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। প্রাচীন ভারতে শিক্ষা এমন একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হত যা শিশুর সার্বিক বিকাশসাধন–এর সহায়ক।

• উপনিষদে উল্লেখ আছে, “আচার্য্যঃ পূরব্রুপ অন্তেবাসৌ উত্তররূপ বিদ্যা সংবিধঃ প্রবচনং সংধানং,” অর্থাৎ শিক্ষা এমন এক প্রক্রিয়া যার মধ্যে ‘জ্ঞান‘ শিক্ষকের দিক থেকে শিক্ষার্থীর দিকে প্রবাহিত হয়, যেমন প্রাকৃতিক নিয়মে উচ্চকোটি থেকে নিম্নকোটিতে প্রবাহ।
• প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ঋক্ বেদে বলা হয়েছে, “Education is something which makes a man self-reliant and selfless”, অর্থাৎ শিক্ষা মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং আত্মত্যাগের ব্রতে ব্রতী হতে উদ্বুদ্ধ করে।
• প্রখ্যাত বৈয়াকরণ পাণিনির (Panini) মতে, “Human Education means the training which one gets from nature,” অর্থাৎ মানুষের শিক্ষা হল সেই শিক্ষণ যা সে প্রকৃতির কাছ থেকে পেয়ে থাকে।
• বিশিষ্ট চিন্তাবিদ যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, “শিক্ষা হল সৎ চরিত্র গঠনের এবং সমাজ-উপযোগী ব্যক্তিত্ব গঠনের একমাত্র সহায়ক কৌশল।”
• অর্থশাস্ত্র প্রণেতা কৌটিল্যের মতে, “Education means training for the country and love for the nation.” অর্থাৎ শিক্ষা হল দেশ সেবার জন্য উপযুক্ত শিক্ষণ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা।
• আদিগুরু শঙ্করাচার্য শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন, “Education is the realization of self.” অর্থাৎ শিক্ষা হল নিজেকে উপলব্ধি করা।
• বিশিষ্ট চিন্তাবিদ কণ্বাদ বলেছেন, “শিক্ষার প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, এর মাধ্যমে মানুষের আত্মসন্তুষ্টির (Self Contentment) যথার্থ আদর্শ দিকে বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়।”

আধুনিক ভারতীয় ধারণায় শিক্ষা (Educational Concept of Modern India)

আধুনিককালের অনেক ভারতীয় শিক্ষাবিদ এবং চিন্তাবিদ শিক্ষার তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

• ভারতীয় বেদান্তদর্শনের তথা আধুনিক চিন্তাধারার মুখপাত্র স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধে বলেছেন, “Education is the manifestation of perfection already in man. Like fire in a piece of flint knowledge exists in the mind.” অর্থাৎ শিক্ষা হল মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ। চকমকি পাথরের মধ্যে যেমন আগুন লুকিয়ে থাকে, জ্ঞানও তেমনি মনের মধ্যে থাকে।
• স্বামী দয়ানন্দ বলেছেন, “Education is a means for character formation and righteous living,” অর্থাৎ শিক্ষা হল চরিত্র গঠন এবং সঠিক জীবনযাপনের উপায়।
• দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ মহাত্মা গান্ধীর দৃষ্টিতে, “By Education, I mean an all-round drawing out of the best in child and man body, Mind and Spirit,” অর্থাৎ শিক্ষা হল শিশু ও বয়স্ক মানুষের দেহ, মন ও আত্মার শ্রেষ্ঠ গুণাবলির পূর্ণতার বিকাশ।
• বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, “The highest education is that which does not merely give us information but makes our life in harmony with all existence.” অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হল তাই যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্বসত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।
• শ্রী শ্রী ঋষি অরবিন্দের মতে, “Education means helping the growing soul to draw out that is in itself,” অর্থাৎ শিক্ষা বলতে বোঝায় ব্যক্তির অন্তর্নিহিত জাগ্রত আত্মার বিকাশসাধন।
• ভারতরত্ন প্রাপক মহান শিক্ষক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ বলেছেন, “Education according to Indian tradition is not merely a means to earning a living: nor it is only a nursery of a thought or a school for citizenship. It is initiation into the life of spirit, a training of human souls in the pursuit of truth and the practice of virtue. It is a second birth, ‘Dwitiyam Janman’.” অর্থাৎ ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে শিক্ষা কেবলমাত্র জীবিকা অর্জনের পন্থা মাত্র নয়, এমনকি চিন্তা ও ভাবের সূতিকাগৃহ বা নাগরিকত্ব অর্জনের প্রতিষ্ঠানও নয়। এ হল জীবনের প্রবর্তনা, সত্যানুসন্ধান ও ধর্মাচরণে দীক্ষালাভ। এটি হল দ্বিতীয় জন্ম বিশেষ।

পাশ্চাত্য ধারণায় শিক্ষা (Educational Concept of Western):

পাশ্চাত্য দার্শনিক ও শিক্ষাবিদগণ তাঁদের শিক্ষা সম্পর্কীয় যে চিন্তাধারা প্রকাশ করেছেন, তা একটি সুসংহত কার্যাবলীর মধ্য দিয়ে ব্যক্তিকে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত নাগরিক হতে সাহায্য করে থাকে।

• প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, “Education is the creation of a sound mind in sound body,” অর্থাৎ সুস্থ দেহে, সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা।
• দার্শনিক প্লেটো বলেছেন, “Education develops in the body and soul of the people all the beauty and all the perfection he is capable,” অর্থাৎ শিক্ষা শিশুর নিজস্ব ক্ষমতানুযায়ী দেহ, মনের সার্বিক বিকাশে সাহায্য করে।
• দার্শনিক জন লক (Locke) বলেছেন, “Education in its widest meaning is the moulding of life,” অর্থাৎ ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল জীবনের পরিবর্তন সাধন।
• দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ রুশো (Rousseau) বলেছেন, “Education is child`s development from within.” অর্থাৎ শিক্ষা হল শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ।
• শিক্ষাবিদ পেস্তালৎসি (Pestalozzi) বলেছেন, “Education is natural harmonious and progressive development of man`s innate powers,” অর্থাৎ শিক্ষা হল মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি সমূহের স্বাভাবিক, সুষম ও প্রগতিশীল বিকাশ।
• শিক্ষাবিদ হার্বাট স্পেন্সার (Herbert Spencer) বলেছেন, “Education is the preparation for complete living in future,” অর্থাৎ শিক্ষা হল ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ জীবন যাপনের প্রস্তুতি।
• শিক্ষাবিদ ফ্রয়েবেল (Froebel) বলেছেন, “Education is the unfoldment of what is already infolded in the germ,” অর্থাৎ শিক্ষা হল অন্তর্নিহিত সুপ্ত সম্ভাবনার উন্মেষণ।
• শিক্ষাবিদ নান (Nunn) বলেছেন, “Education is the complete development of the individuality to human life according to the best of his capacity,” অর্থাৎ শিক্ষা হল শিশুর ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশসাধন যার দ্বারা সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী মানবজীবনে কিছু মৌলিক অবদান রেখে যেতে পারে।
• শিক্ষাবিদ ও চিকিৎসক মাদাম মারিয়া মন্টেসরি (Madam Maria Montessori) বলেছেন, “Education means helping in the complete unfolding of the child`s personality,” অর্থাৎ শিক্ষা বলতে বোঝায় শিশুর ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ উন্মোচনে সাহায্য করাকে।
• আবার, আধুনিক শিক্ষাবিদ জন ডিউয়ে (John Dewey) বলেছেন, “Education is the process of living thought a continuous reconstruction of experiences. It is the development of all those capacities in the individual which will capable him to control his environment and fulfil his possibilities,” অর্থাৎ শিক্ষা হল অভিজ্ঞতার প্রতিনিয়ত পুনর্গঠনের মাধ্যমে জীবনযাপনের প্রক্রিয়া। এটি মানুষের শক্তি সমূহের এমন একটি বিকাশ যা তার পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ এবং সম্ভাবনাগুলিকে বিকশিত করতে পারে।

উপসংহার:

এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার ধারা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, শিক্ষার অর্থ ও তার তাৎপর্য সংক্রান্ত ধারণা দেশ, কাল ও ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। প্রাচীন ও আধুনিক ভারতীয় মতামতগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেই সব ক্ষেত্রে শিক্ষাকে শুধুমাত্র আত্মোপলব্ধির সমপর্যায়ে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার, পাশ্চাত্য মনিষীদের মতামতগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাঁরা শিক্ষার তাৎপর্য ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে অতি বাস্তববাদী হয়ে পড়েছেন।

তাই আধুনিক বাস্তবধর্মী শিক্ষা সংক্রান্ত ধারণার সঙ্গে ভারতীয় সমাজ দর্শনের আত্মোপলব্ধির সমন্বয় সাধন করে একটি সর্বজনগ্রাহ্য ধারণা গঠন কিছুটা সম্ভব হয়েছে। এই সমন্বয়ী ধারণা অনুযায়ী – “শিক্ষা হলো সমাজের চাহিদা অনুযায়ী শিশুর উপর পরিণত ব্যক্তিদের সুপরিকল্পিত প্রভাবের সমষ্টি যা তার সুষম দেহমনের বিকাশের মাধ্যমে জীবনের পরম সত্যকে উপলব্ধি করতে তাকে সহায়তা করে।”