বিএড (B.Ed) কী?
বিএড (Bachelor of Education) হলো শিক্ষকতা পেশার জন্য একটি পেশাদার স্নাতক ডিগ্রি। এটি মূলত ২ বছর মেয়াদী একটি কোর্স, যা সেমিস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। এই কোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের তাত্ত্বিক জ্ঞান, ব্যবহারিক কৌশল এবং শ্রেণীকক্ষ পরিচালনার দক্ষতা শেখানো হয়।
পশ্চিমবঙ্গে এই কোর্স BSAEU (বাবা সাহেব আম্বেদকর এডুকেশন ইউনিভার্সিটি) এবং NCTE (জাতীয় শিক্ষক শিক্ষা পরিষদ) অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে করা যায়। বিএড ডিগ্রি উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক হওয়ার জন্য আবশ্যক। এছাড়াও, WB TET বা CTET পরীক্ষায় বসতে এই ডিগ্রি প্রয়োজন।
কোর্সটিতে শিক্ষার মনস্তত্ত্ব, পাঠ পরিকল্পনা, মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং শিক্ষা প্রযুক্তির ব্যবহার শেখানো হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কলেজে বিএড পড়ার সুযোগ রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদেরকে দক্ষ শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলে।
কেন বিএড করবেন?
১. শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের বাধ্যতামূলক যোগ্যতা:
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগের জন্য B.Ed ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে NCTE (জাতীয় শিক্ষক শিক্ষা পরিষদ) – এর নির্দেশনা অনুযায়ী।
প্রাথমিক স্তর (Class I-V):
- D.El.Ed (Diploma in Elementary Education) বা B.Ed প্রয়োজন।
- WB TET (পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক যোগ্যতা পরীক্ষা)পাস করতে হবে।
- ২০২৩ সালের নিয়ম অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগেEd + D.El.Ed সমন্বিত কোর্সের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
মাধ্যমিক (Class VI-VIII) ও উচ্চ মাধ্যমিক (Class IX-XII):
- B.Ed ডিগ্রি আবশ্যক।
- CTET/WB TET পাস করতে হবে (CBSE স্কুলগুলোর জন্য CTET, রাজ্য স্কুলগুলোর জন্য WB TET)।
- WBCHSE-এর অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক হওয়ার জন্য বিষয়ভিত্তিক PG + B.Ed প্রয়োজন।
উদাহরণ: একজন বাংলা শিক্ষক হতে চাইলে বাংলায় স্নাতকোত্তর + B.Ed আবশ্যক। CBSE স্কুলে চাকরির জন্য CTET এবং WBBSE স্কুলে চাকরির জন্য WB TET প্রয়োজন।
২. সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে চাকরির সুযোগ:
সরকারি স্কুল:
- WBBSE (পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ) এবং WBCHSE (উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ)-এর অধীনে শিক্ষক নিয়োগে B.Ed বাধ্যতামূলক।
- SLST (State Level Selection Test) পরীক্ষার মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগ হয় (২০২৩ সাল থেকে নতুন পদ্ধতি)।
- প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ WBBPE দ্বারা পরিচালিত হয় এবং এখানে TET পাস প্রয়োজন।
কেন্দ্রীয় স্কুল:
- KVS (Kendriya Vidyalaya), NVS (Navodaya Vidyalaya)-এ B.Ed ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
- CBSE স্কুলগুলোতেCTET + B.Ed + PG প্রয়োজন।
বেসরকারি স্কুল:
- নামীদামী প্রাইভেট স্কুল (যেমন:DPS, South Point, Don Bosco) B.Ed ডিগ্রি এবং বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা চায়।
- আন্তর্জাতিক স্কুল(IGCSE/IB) সাধারণত B.Ed + শিক্ষণ অভিজ্ঞতা চায়।
উদাহরণ:
- SLSTপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েসরকারি মাধ্যমিক স্কুলে স্থায়ী চাকরি পাওয়া যায়।
- KVS-এPRT (Primary Teacher)হতে B.Ed + CTET প্রয়োজন।
৩. উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ:
M.Ed (Master of Education):
- B.Ed-এর পরM.Edকরে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হওয়া যায়।
- পশ্চিমবঙ্গে B.Ed করার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য।
NET/SET:
- UGC NET বা WB SET পাস করে সহকারী অধ্যাপক হওয়া যায়।
- NTA দ্বারা পরিচালিত NET পরীক্ষায় Education বিষয়ে গবেষণার সুযোগ রয়েছে।
Ph.D. ও গবেষণা:
- B.Ed + M.Ed-এর পর Ph.D.করে শিক্ষানীতি, শিক্ষা প্রযুক্তি বা শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে গবেষণা করা যায়।
- SCERT, NCERT-এর মতো প্রতিষ্ঠানে গবেষণার সুযোগ রয়েছে।
উদাহরণ: রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে M.Ed করে DIET (District Institute of Education and Training)-এ প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়া যায়।
৪. স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং:
মাইক্রো টিচিং: ছোট গ্রুপে শিক্ষাদানের অনুশীলন করা হয়, যাতে বাস্তব ক্লাসরুমের জন্য প্রস্তুত হওয়া যায়।
ইন্টার্নশিপ:
- ২০ সপ্তাহের বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ স্কুলে করতে হয় (NCTE নির্দেশিকা অনুযায়ী)।
- পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলে ইন্টার্নশিপের বিশেষ সুযোগ রয়েছে।
লেসন প্ল্যানিং ও মূল্যায়ন:
- কীভাবে পাঠ পরিকল্পনা করতে হয় এবং শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে হয়, তা শেখানো হয়।
- NEP 2020-এর আলোকেডিজিটাল শিক্ষা পদ্ধতিপ্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
শিশু মনস্তত্ত্ব: বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষাদান (Inclusive Education) সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
উদাহরণ: কলকাতার SCERT কলেজে স্মার্ট ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট শেখানো হয়।
৫. সম্মানজনক পেশা ও সামাজিক স্বীকৃতি:
স্থিতিশীল ক্যারিয়ার:
- সরকারি স্কুলে বেতন, পেনশন, মেডিকেল সুবিধা রয়েছে।
- পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন৭ম বেতন কমিশন অনুযায়ী ₹৩৫,০০০ – ₹১,১০,০০০ (পদ ও অভিজ্ঞতা অনুসারে)।
সামাজিক মর্যাদা:
- শিক্ষকতা পেশাকে“জাতি গঠনের কারিগর”হিসেবে সম্মান দেওয়া হয়।
- গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলেশিক্ষকদের বিশেষ সম্মান রয়েছে।
চাকরির নিরাপত্তা: সরকারি চাকরিতে স্থায়ী নিয়োগ ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা রয়েছে।
উদাহরণ: একজন সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক হিসেবে গ্রামে বা শহরে সম্মানজনক জীবনযাপন করা যায়।
সর্বশেষ তথ্য:
- NEP 2020-এর অধীনে৪ বছরের সমন্বিত B.Ed কোর্স চালু হচ্ছে।
- WB SLSTপরীক্ষায় B.Ed ডিগ্রিধারীদের জন্য আলাদা ক্যাটাগরি রয়েছে।
- ডিজিটাল শিক্ষক প্রশিক্ষণেGoogle Classroom, Interactive Whiteboard ব্যবহার শেখানো হয়।
পশ্চিমবঙ্গে বিএড করার যোগ্যতা:
বিষয় | শর্ত |
শিক্ষাগত যোগ্যতা | স্নাতক (যেকোনো স্ট্রিমে) ন্যূনতম ৫০% নম্বরসহ |
বয়স সীমা | সাধারণত কোনো বয়সসীমা নেই (কিন্তু স্কুল নিয়োগে আলাদা শর্ত থাকতে পারে) |
এন্ট্রান্স টেস্ট | বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি B.Ed কলেজে, প্রবেশিকা পরীক্ষার বদলে একাডেমিক স্কোরিং এবং কাউনসিলিং চালু হয়েছে। |
পশ্চিমবঙ্গে বিএড কলেজের ধরন:
১. সরকারি বিএড কলেজ:
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি বিএড কলেজগুলির মধ্যে বাবা সাহেব আম্বেদকর শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় (BSAEU) প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। ২০১৬ সাল থেকে রাজ্য সরকার সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি বিএড কলেজকে BSAEU-এর অধীনে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এছাড়াও, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধীনস্থ কিছু সরকারি বিএড কলেজ রয়েছে। এই কলেজগুলিতে ভর্তির জন্য সাধারণত WB JENPAUH প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। সরকারি কলেজগুলির মূল সুবিধা হল কম টিউশন ফি, উন্নত অবকাঠামো এবং সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার।
২. প্রাইভেট বিএড কলেজ:
পশ্চিমবঙ্গে NCTE অনুমোদিত অনেক প্রাইভেট বিএড কলেজ রয়েছে, যেমন লোরেটো কলেজ, ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটি কলেজ, আরামবাগ শিক্ষা কলেজ ইত্যাদি। যদিও এগুলি বেসরকারি খাতে পরিচালিত হয়, তবুও এগুলি BSAEU বা অন্যান্য রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। প্রাইভেট কলেজগুলির মূল বৈশিষ্ট্য হল তুলনামূলকভাবে সহজ ভর্তি প্রক্রিয়া এবং আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি। তবে এগুলির টিউশন ফি সরকারি কলেজের তুলনায় বেশি এবং শিক্ষার মান কলেজভেদে ভিন্ন হয়।
৩. ইউনিভার্সিটি ডিপার্টমেন্ট:
পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নিজস্ব শিক্ষা বিভাগে সরাসরি বিএড কোর্স করা যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদ এবং উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগ উল্লেখযোগ্য। এই বিভাগগুলিতে উচ্চমানের শিক্ষাদান এবং গবেষণার সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগে ভর্তির জন্য সাধারণত স্নাতকে ন্যূনতম ৫০% নম্বর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এখান থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার বিশেষ সুযোগ থাকে।
ক্যারিয়ার অপশন – পশ্চিমবঙ্গে বিএড পর কী?
- স্কুল টিচার– সরকারি/বেসরকারি প্রাইমারি, মাধ্যমিক স্কুলে।
- TET/CTET পরীক্ষাদিয়ে স্থায়ী চাকরি পাওয়া।
- টিউশন সেন্টার বা কোচিং সেন্টারচালানো।
- এডুকেশন কনসালট্যান্টবা শিক্ষা সংক্রান্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ।
- B.Ed + NET/SETকরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা।
উদাহরণ: পশ্চিমবঙ্গের একজন বিএড গ্র্যাজুয়েটের ক্যারিয়ার পথ
ধরুন, রিনা (কলকাতা)
- বাংলাতে অনার্স – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
- B.Ed– SCERT কলেজ থেকে।
- WB TET পাসকরে প্রাইমারি টিচার হিসেবে নিয়োগ পেলেন।
- পরে M.Ed করে সহকারী প্রফেসর হিসেবে কলেজে যোগ দিলেন।
সিদ্ধান্ত: বিএড কি আপনার জন্য?
✅ হ্যাঁ, যদি…
- আপনি শিশু বা তরুণদের পড়াতে পছন্দ করেন।
- চাকরির স্থিতিশীলতা চান।
- শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে চান।
❌ না, যদি…
- আপনি অন্য কোনো পেশায় আগ্রহী (যেমন: ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল)।
- শিক্ষকতার ধৈর্য ও দায়িত্ব নিতে না চান।
শেষ কথা
পশ্চিমবঙ্গে B.Ed শুধুমাত্র একটি ডিগ্রি নয়, বরং এটি একজন আগ্রহী শিক্ষার্থীর জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকতার পেশায় প্রবেশের জন্য এটি একটি অপরিহার্য শর্ত। সরকারি ও সরকার-সহায়তা প্রাপ্ত বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি পেতে B.Ed ডিগ্রি আবশ্যিক, ফলে এটি একটি “গোল্ডেন টিকেট” হিসেবেই বিবেচিত হয়।
এই ডিগ্রি শুধুমাত্র একটি চাকরির দরজা খোলে না, বরং একজন শিক্ষার্থীকে একজন দক্ষ, নৈতিক এবং দায়িত্ববান শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে পাওয়া যায় সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং পেনশন সহ জব সিকিউরিটির নিশ্চয়তা। শিক্ষাদান একটি সেবামূলক পেশা—এতে মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার সুযোগ থাকে।
যদি আপনার মধ্যে শিক্ষাদানের প্রতি ভালোবাসা, ধৈর্য, নেতৃত্বের গুণাবলি এবং সমাজে অবদান রাখার ইচ্ছা থাকে, তবে নিঃসন্দেহে B.Ed আপনার জন্য একটি যথার্থ এবং ভবিষ্যতমুখী সিদ্ধান্ত। সঠিক প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে মনোযোগ সহকারে এই কোর্স সম্পন্ন করলে আপনার জন্য উজ্জ্বল কর্মজীবনের পথ প্রশস্ত হবে।
👉 আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে WhatsApp -এ জানাতে পারেন! 😊
📖 ব্লগ পোস্টটি ডাউনলোড করুন
নিচের বাটনে ক্লিক করে পিডিএফ ডাউনলোড করুন এবং আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে সাপোর্ট করুন!
✅ সাবস্ক্রাইব করলে ভবিষ্যতে আরও ফ্রি কন্টেন্ট পাবেন!